বাংলা সাহিত্যে সমরেশের “কালবেলা” একটা মাস্টারপিস। কিন্তু চলচিত্রে তা হল না।আসলে বাংলা ভাষায় অনন্য সাহিত্য সৃষ্টি হলেও তার যখন কেঊ চলচিত্র রূপ দান করেন এবং করছেন, তখন তার আর সেই অনন্যতা বজায় থাকে না।
নিঃ সন্দেহে সেক্ষেত্রে চলচিত্রকরদের দায় ই ১০০ ভাগ। তাই যুগে যুগে আমরা দর্শকরা “দেবদাস”, “শ্রীকান্ত” দেখে হতাশ হয়েছি। দেখা গেল সিনেমা হলে দেদার ব্যাবসা করলেও তার শুদ্ধ শিল্প রূপ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। একজন বাঙ্গালী চলচিত্রকারকে দেখা যায় তাই পূরো গল্প পালটে নতুন গল্প ফাদতে। সেটা যে একটা ভাষার সবচেয়ে মূল্যবান উপাদানটির প্রতিনিধিত্ব করবে, তা আর মাথায় থাকে না। ঐ যে বলেনা,অন্নচিন্তা চমতকারা! বাঙ্গালী চলচিত্রকাররা সর্বদাই পরের ধণে পোদ্দারী করতে পছন্দ করেন। ঠিক এইজন্য ওদেরকে আমি বাঙ্গালী না বলে কাঙ্গালী ভাবতেই বেশি পছন্দ করি।
যাহোক, আজ বহু বহু আশা নিয়ে দেখতে বসেছিলাম আমার সবচেয়ে প্রিয় বাংলা উপন্যাস “কালবেলা” র চলচিত্র রূপ। রূপালী পর্দার অনিমেষ রূপে পরব্রতকে দেখে আশান্বীত ও হয়েছিলাম। মাধবীলতা চরিত্রে পাওলী ও আসনে বসনে বেশ মানিয়ে গিয়েছিল।পাওলী দাম যতই সেক্স সিম্বলিক হোক তার অভিনয় দক্ষতার প্রতি ভরসা ছিল।কিন্তু পুরোটা দেখে মনে হল, ঢেকি স্বর্গে গেলেও আসলেই ধান ভানে।প্রচন্ড গভীর মনের মেয়ে মাধবীলতা চরিত্রটিকে পাওলী মাঝে মাঝে খেলো করে ফেলেছে।তবে ওর দোষ দিয়ে লাভ নেই,পরিচালক ওকে দিয়ে যে কথা বলিয়েছেন, যেভাবে চোখ ঘোড়াতে বলেছেন , ওতো তাই করবে,নাকি?
অবশ্য কাহিনীর কথোপকথন যে সব জায়গায় অপরিবর্তীত ছিল, সেসব জায়গায় পাওলী স্বভাবসিদ্ধ নিপুনতায় অভিনয় করে গেছেন ।শুধু রবীন্দ্র সংগীতগুলো ছাড়া! ঐ বেসু্রো গলায় এ্যত সুন্দর গানগুলো ওকে দিয়ে না গাওয়ালেই কী হত না?
আর পরব্রত কে রীতিমত কোথাও কোথাও যন্ত্রের মত মনে হয়েছে। যদিও অনিমেষের স্বভাবসুলভ নেতৃত্ব এবং সারল্যকে সে ভালই ফোটাতে পেরেছে।কিন্তু সেন্সেটিভ জায়গাগুলোতে এতটাই কী অ্যামেচার ছিল অনিমেষ? বোধহয় না।।মহৎ কিছু সৃষ্টি করতে গেলে ব্যাবসার কথা চিন্তা করলে চলে না ।গৌতম ঘোষ এর বোঝা উচিত ছিল এই ফিল্ম দিয়ে তিনি ট্রাডিশনাল বাঙ্গালী দর্শকদের হলে টানতে পারবেন না। অতএব,কাহিণী পরিবর্তনের কোন দরকার ছিল না।বরং কোনকিছু পরিবর্তন না করলেই বরং আরো সুন্দর হত।
মাঝে মাঝে খুব আফসোস হয়,আমাদের অনেক শিল্পগুনসম্পন্ন উপন্যাস আছে যেগুলো যদি ঠিকভাবে চলচিত্র রূপ দেয়া যায়, হলিঊডের মুভীর মত বা তার চেয়ে ভাল সিনেমা হতে পারে, যেমন “গর্ভধারিনী”, “গেড়িলা থেকে সম্মুখ সমরে”, “চাঁদের পাহাড়” এমন অজস্র ……কিন্তু কোন সাহসী ও মেধাবী চলচিত্রকারকে আমরা এখনো পাচ্ছি না যারা অর্থচিন্তা বাদ দিয়ে শিল্প বা শুধু প্যাশন নিয়ে কাজ করে যাবে।অন্যদিকে হলিঊডের দিকে তাকালে সত্যি ই ঈর্ষা জাগে। ওরা এক “জেন আয়ার” ই বানিয়েছে এ পর্যন্ত নূন্যতম ৬ বার।একজন পাশ করে বের হওয়া নতুন পরিচালকের হাতেখরি ই হয় ইংরেজী সাহিত্যের মাস্টারপিসগুলি দিয়ে। আর সেখানে আমরা এখনো কোথায় পড়ে আছি। জানি এই গৌতম ঘোষ ই হয়তো এখন আবার “কালবেলা” বানাতে গেলে আরো ভাল বানাবেন,কারন এখন তিনি অনেক ম্যাচিউরড।
যারা চলচিত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন ,তাদের কাছে আমার অনুরোধ ,দয়া করে কেউ অসাধারন ঊপন্যাসগূলোর কাহিনী পরিবর্ধন বা পরিবর্তন করে চলচিত্র রূপ দেয়ার চেষ্টা করবেন্না।কারন দর্শকরা যেহেতু কাহিনী জেনেই হলে যায়,তাই তাদের নতুন কাহিনী না শোনানোই ভাল।বরং কীভাবে তাদের কল্পনায় আকা চরিত্র এবং কাহিনীকে আরো জীবন্ত ও অনুভূতিপ্রবণ করে ঊপস্থাপন করা যায় সেই চেষ্টা ই করবেন!